সোনারগাঁও (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি:
নারায়ণগঞ্জের কাচপুর বাসস্ট্যান্ড। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল করা দূরপাল্লার প্রায় সব বাসের কাউন্টার রয়েছে এখানে। এ ছাড়া লোকাল অনেক পরিবহন এখান থেকে যাত্রী তুলে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়।
এতে বাসস্ট্যান্ডটিতে প্রতিদিন লাখো মানুষের সমাগম হয়। এই বাসস্ট্যান্ড থেকে মেঘনা টোলপ্লাজার দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। যেসব যাত্রীরা এই পথে যাতায়াত করেন তাদের এই ১৪ কিলোমিটার অংশে উল্টোপথের তিন চাকার গাড়ির কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয়। সংযোগসড়ক থেকে হঠাৎ মহাসড়কে উঠে পড়া এসব গাড়ির কারণে দ্রুতগতির গাড়িকে তাৎক্ষণিক ব্রেক করতে হয়। কখনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা।
কিন্তু এসব গাড়ি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। অভিযোগ আছে, প্রতি মাসে টোকেনবাবদ টাকা দিয়ে এসব গাড়ি চলাচল করে। আর সেগুলো নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠেছে ‘শক্তিশালী সিন্ডিকেট’।
হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, কাচপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে মেঘনা টোলপ্লাজা পর্যন্ত এলাকায় গত ১৪ মাসে ছোট বড় ৮৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক যাত্রী ও পথচারী আহত হয়েছেন। বেশিরভাগ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তিন চাকার যানবাহনকে দায়ী করেছে পুলিশ। তবে কারণ শনাক্ত হলেও দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধে হাইওয়ে বা থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
গতকাল বুধবার মহাসড়কের কাচপুর থেকে মেঘনা টোলপ্লাজা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, ১৪ কিলোমিটার পথের মধ্যে সাতটি স্থানে অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। এসব স্ট্যান্ডে ইজিবাইক, ভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ভটভটি রাখায় যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। দিন-রাত সমানতালে এসব স্ট্যান্ড থেকে তিন চাকার গাড়িগুলো মহাসড়কে উল্টোপথে ছুটে চলছে। আর ৫ আগস্টের পর থেকে এই পথে হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, তিন চাকার যান চলাচলের জন্য একটি ‘শক্তিশালী সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে হাইওয়ে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে মাসিক চাঁদা দেওয়া হয়। যেসব যান এই সিন্ডিকেটের আওতায় রয়েছে তাদের যানে বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
মহাসড়কের মদনপুরে কথা হয় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের চালক কবির হোসেনের সঙ্গে। উল্টোপথে ইজিবাইক চালানোর বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে তিনি এর পেছনে নিজের যুক্তি দাঁড় করান। বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি আছে, এটা সত্য। তবে পেটের তাগিদে এভাবে চালাতে হয়। এই সড়কে ইজিবাইক চালাতে হলে টোকেন নিতে হয়। প্রতি মাসে ওই টোকেনের জন্য তিন হাজার টাকার বেশি দিতে হয়।’
যাত্রীদের কম দূরত্বে যাতায়াত ও মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য অবৈধযান নসিমন-করিমনের চাহিদা ওই এলাকায় সবচেয়ে বেশি। এমনই এক নসিমনের চালক লাঙ্গলবন্দ এলাকায় মো. জসিম বলেন, ‘মাঝে-মধ্যে পুলিশ ঝামেলা করলেও বেশিরভাগ সময় নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারি।’
এদিকে তিন চাকার এসব যানের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এ কারণে যাত্রীরা একরকম বাধ্য হয়েই এসব গাড়িতে উঠেন। মেঘনাঘাট এলাকায় কথা হয় অটোরিকশার যাত্রী স্থানীয় ঝাউচর গ্রামের বাসিন্দা আবু হানিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল, বাজার, স্কুল-কলেজে যেতে এ পথই ব্যবহার করতে হয়। মহাসড়কে চলাচলে কোনো গণ-পরিবহন পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়েই অটোরিকশা বা অন্য বাহন ব্যবহার করতে হয়।’
সেখানে থাকা সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক রহিম মিয়া বলেন, ‘আমি ঋণ করে সিএনজি কিনেছি। ভেতরের সড়কে ভাড়া কম। এখন যদি মহাসড়কে না চালাতে পারি, পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। নিরুপায় হয়ে মহাসড়কে গাড়ি চালাচ্ছি।’
এদিকে মহাসড়কে চলা তিন চাকার যানের কারণে বিপাকে পড়েন দূরপাল্লার বাসের চালকরা। দ্রুতগতির এসব গাড়িকে তিন চাকার ধীরগতির যানের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। কাচপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে কুমিল্লাগামী একটি পরিবহনের বাসচালক ইয়াছিন মিয়া বলেন, ‘নিষিদ্ধ এসব যান হঠাৎ করেই সংযোগ সড়ক থেকে মহাসড়কে উঠে পড়ে। তখন জরুরি ব্রেক করলে যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আমরা এই সমস্যার সমাধান চাই।’ তার কথার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ট্রাকচালক সুমন সরকার বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশ ঠিকমত কাজ না করায় পরিস্থিতি এত খারাপ হয়েছে।’
এসব বিষয়ে কাচপুর হাইওয়ে থানার ওসি কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ বলেন, ‘অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। হাইওয়ে পুলিশ এসব যানচলাচলে বাধা দেয়। কিন্তু পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা মহাসড়কে উঠে পড়ে। তবে পুলিশের সামনে পড়লেই গাড়িগুলো আটক করা হয়।’
এসব গাড়ি থেকে চাঁদা নেওয়া হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে পুলিশের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া কেউ সিন্ডিকেট বানালে থানা-পুলিশের সহায়তায় তাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সূত্র: দৈনিক খবরের কাগজ
প্রতিবেদক: ইমরান হোসেন।